যে কোন প্রতিষ্ঠানের নামকরণের পেছনে কোন ইতিহাস বা উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। প্রতিষ্ঠান শুরু করার উদ্দেশ্য, তার নীতি ও আদর্শ অনেক সময় এই নামকরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। ‘নটর ডেম’ নামের অর্থ কী? এই নামকরণের মধ্য দিয়ে কি কোন উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে? কৌতূহলী ছাত্রদের মনে এসব প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া কলেজের ছাত্র হিসেবে সবারই এসব প্রশ্নের উত্তর জানা উচিত।
নটর ডেম (Notre Dame) শব্দ দু’টো ফরাসী ভাষা থেকে নেয়া। ইংরেজিতে এর অনুবাদ হচ্ছে ‘Our Lady’। রোমান কাথলিকগণ ‘Our Lady’ বলতে যিশু খ্রিস্টের জননী মারীয়া বা মেরীকে বুঝে থাকে। তাঁর প্রতি তাদের অগাধ ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করার জন্য বাইবেল বর্ণিত সেই অনন্যা নারীকে তারা এভাবে সম্বোধন করে থাকে। নটর ডেম কলেজ সেই মহীয়সী নারী মরিয়মের নামে উৎসর্গীকৃত। যিশু খ্রিস্টের “জ্ঞানে ও বয়সে, ঈশ্বর ও মানুষের ভালবাসায়” বেড়ে ওঠায় মারীয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁর সেই মাতৃসুলভ ভালবাসা দিয়ে ছাত্রদের প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে উঠতে সহায়তা করার জন্যই নটর ডেম কলেজের এই নামকরণ।
নটর ডেম কলেজের নামকরণের পেছনে আরও একটি কারণ আছে। এই কলেজ যারা পরিচালনা করে তাঁরা হলেন হলি ক্রস সন্ন্যাস-সংঘের ধর্মযাজক (The Congregation of Holy Cross Priest Society) । হলি ক্রস সন্ন্যাস-সংঘের ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টারদের নামের পরে লেখা থাকে ‘সি.এস.সি.’। অনেকেই এর ব্যাখ্যা জানতে চান। ল্যাটিন ভাষায় সন্ন্যাস-সংঘটিকে বলা হয় Congregazione di Santa Croce. CSC বলতে তিনটি শব্দের আদ্যাক্ষর বুঝায় এবং এ সংঘের সবাই এভাবে পরিচিত। কাথলিক চার্চে যাজকদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য তাঁদেরকে ‘ফাদার’ বলে সম্বোধন করা হয়।
হলি ক্রস সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফাদার বাসিল আন্তনী মেরী মরো। ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে ফ্রান্স দেশের যে স্থানে তিনি এই সন্ন্যাস সংঘটি স্থাপন করেছিলেন সেখানকার প্রধান উপাসনালয়ের নাম ছিল ‘আওয়ার লেডী চ্যাপেল’ এবং তা মাতা মেরীর নামে উৎসর্গীকৃত ছিল। আর মাতা মেরীর প্রতি ছিল ফাদার মরোর অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। সুতরাং প্রতিষ্ঠাতার আদর্শ অনুকরণ করেই হলি ক্রস সংঘের ফাদার, ব্রাদার ও সিস্টারগণ তাঁর দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহের এরূপ নামকরণ করে থাকেন।
নটর ডেম কলেজের মূলনীতিকে যে কথার দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে তা হল: ‘Diligite Lumen Sapientiae’ যার ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে: ‘Love the light of wisdom’ ‘জ্ঞানের আলোকে ভালবাস’। ঈশ্বর হচ্ছেন সকল জ্ঞানের উৎস। কাথলিক ধর্মমতে মাতা মেরী হলেন জ্ঞানের প্রতীক, কেননা তিনি ঈশ্বরের মহান অনুগ্রহের পাত্রী। ‘জ্ঞান’ (Sapientia) শব্দটি কলেজের আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ করে। শুধুমাত্র জ্ঞান আহরণই নয়, তদুপরি জ্ঞানের উৎস স্রষ্টাকে অর্থাৎ পরম করুণাময় ঈশ্বরকে লাভ করার উপায় জানতে সহায়তা করাও কলেজের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ‘Lumen’ অর্থ হচ্ছে আলো। আলো অন্ধকারকে দূরীভূত করে এবং মানুষকে পথ চলার শক্তি এবং ভালোমন্দের পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা দেয়। অজ্ঞানতা হচ্ছে অন্ধকারের সামিল। জ্ঞানের আলো মানুষকে আলোকিত ব্যক্তিতে পরিণত করে, এ জগতের আবিলতা থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে সহায়তা করে। ‘Diligite’ শব্দটি হচ্ছে অনুজ্ঞাসূচক, যার অর্থ ‘ভালবাসা’। জ্ঞান যেহেতু কল্যাণকর, সেহেতু ভালবাসা নিয়ে জ্ঞান আহরণ করতে হবে। অন্যায়-অসত্য হচ্ছে অন্ধকারস্বরূপ; আর ন্যায়, সত্য, শান্তি হচ্ছে আলোস্বরূপ। তাই ‘আলো’কে ভাল না বাসলে আমরা পরম মঙ্গলকে চিনতে পারি না।
কলেজের প্রতীকের মাঝখানে রয়েছে একটি খোলাপুস্তক-যার এক পৃষ্ঠায় লেখা আছে ‘আল্ফা’ অর্থাৎ গ্রীক হরফের আদি অক্ষর এবং অপর পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে ‘ওমেগা’ অর্থাৎ গ্রীক হরফের অন্ত অক্ষর। স্বয়ং ঈশ্বর হচ্ছেন সমস্ত কিছুর আদি উৎস এবং সমন্ত কিছুর শেষ বা পরম লক্ষ্য। বই হচ্ছে জ্ঞানের বাহক বা প্রতীক। জ্ঞানার্জনের জন্য তাই বই পড়তে হবে। যুগ যুগের সঞ্চিত জ্ঞান বর্ণমালার সাহায্যে পুস্তকে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে, তা পাঠ ও ধ্যান করে তার নিহিতার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে জীবন আলোকময় হয়ে ওঠে।
কলেজের প্রতীকে দেখা যায় তিনটি ক্ষেত্র। বামদিকের ক্ষেত্রে দেখা যায় ৭টি ‘Fleurs de-lis’, এটি ফরাসী শব্দ যার বাংলা রূপান্তর হচ্ছে পদ্মফুল। পদ্ম হচ্ছে বিশুদ্ধতার প্রতীক। যিশুর মাতা মেরী ছিলেন পদ্মের ন্যায় শুচি ও পবিত্র। ৭টি পদ্ম দ্বারা মাতা মেরীর জীবনের ৭টি শোককে প্রকাশ করা হয়েছে। তাঁর জীবনের ৭টি দুঃখময় ঘটনার স্মরণে তাঁকে বলা হয় সপ্তশোকের জননী। তিনি তাঁর পুত্র যিশুর জন্য যে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছিলেন তা জগতের প্রলয়কাল পর্যন্ত সকলে স্মরণে রাখবে। এ জগতে দুঃখকষ্ট আমাদের জীবনের বাস্তবতা, দুঃখকষ্টকে সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ভালবাসার কারণে দুঃখকষ্টকে বরণ করে নিতে পারলে তার পরিণাম হয় শুভ। প্রকৃত জ্ঞানার্জন সহজ নয়, তা লাভ করার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন তা অতি কষ্ঠসাধ্য; কিন্তু জ্ঞান সুখদায়ক, জ্ঞানবান ব্যক্তি প্রকৃত সুখী মানুষ।
ডানদিকের ক্ষেত্রটি বাংলাদেশের ভূমিতে কলেজটির অবস্থানের প্রতীক। আমাদের এ মাতৃভূমি সবুজ-শ্যামলে সুন্দর। উদীয়মান সূর্য নতুন দিনের নতুন আশার প্রতীক। জলভরা নদী, চলমান নৌকা, সোনালী ধানক্ষেত আর সীমাহীন নীলাকাশ শোভিত এই সোনার বাংলায় নটর ডেম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য।
নিচের ক্ষেত্রটিতে আড়াআড়িভাবে বসানো নোঙরদ্বয়ের মাঝখানে স্থাপিত ক্র ুশটি হলি ক্রস সন্ন্যাস সংঘের প্রতীক। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, যিশু খ্রিস্ট ক্র ুশের উপরে মৃত্যুবরণ করেই মানবজাতির মুক্তি সাধন করেছেন। ক্র ুশার্পিত সেই খ্রিস্টকে নোঙরের ন্যায় আঁকড়ে ধরে জীবন যাপন করলে নাজাৎ বা পরিত্রাণ লাভ করা যায়। সুতরাং নোঙর হচ্ছে আশার প্রতীক। ভাসমান নৌকা বিক্ষুব্ধ ঝড়ের দ্বারা এদিক সেদিক তাড়িত হলে নোঙর ফেলেই যেমন হারিয়ে যাওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা পায়, ঠিক সেভাবে খ্রিস্টকে অবলম্বন করে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। অনেক আশা নিয়ে শিক্ষার্থীরা পাল তুলে গভীর জ্ঞানসমুদ্রে পাড়ি জমায়। সাধনায় স্থির ও অবিচল থাকলে ভবিষ্যতে তারা একদিন তীরের সন্ধান পাবেই। সেখানে রয়েছে অনাবিল সুখ-শান্তি-আনন্দ। ক্র ুশ থেকে চারদিকে যে আলো ছড়িয়ে পড়ছে তা যিশু খ্রিস্টের আলো ও মহানুভবতারই প্রতীক।